চৌদ্দগ্রামে দুর্গাপুজার প্রস্তুতি,চলছে প্রতিমা নির্মাণ

মুহা. ফখরুদ্দীন ইমন: গ্রীষ্মের তাপদাহ ও বর্ষার অঝোর বর্ষণের শেষে আসে শরৎ। প্রকৃতিতে পুষ্পরাজির সমারোহ, প্রেম-প্রীতি সৃষ্টি করে অনবদ্য ও আকর্ষনীয় পরিবেশ। দেশের সংস্কৃতির ঐক্যের ধারাকে অনুধাবন করার শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে শরৎকাল, যা আনন্দ ও উচ্ছাসকে প্রবাহমান করে আপন গতিতে। রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কা যাত্রার আগে শ্রী রামচন্দ্র শরৎকালের অমাবস্যা তিথিতে দেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন তাহাই সনাতন ধর্মে শারদীয় দূর্গাপূজা বা দূর্গোৎসব নামে পরিচিত। সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকা মতে জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দূর্গা এই পূজায় প্রতিবারই ঘোড়ায় চড়ে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসেন এবং দোলায় (পালকি) চড়ে বিদায় নেন। শারদীয় দূর্গাপূজা বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।
যুগ যুগ ধরে উদযাপিত হয়ে আসছে শারদীয় দূর্গোৎসব। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনবোধ ও চিন্তাধারার সংমিশ্রণের ফলে ধর্মের মর্মবাণীতে এক সংহতির পরিবেশ সৃষ্টি হয় শারদীয় দূর্গোৎসবে, যা এই উৎসবকে করে আরো টেকসই। শিউলি ফুলের সুভাস, বাতাসের হিমেল মধুর পরশ, ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময় ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয় শরতের সকাল-সন্ধ্যায়। আকাশে সাদা মেঘের আনাঘোনায় আকুল করা মনকে করে আন্দোলিত ও উৎসবমূখর, হৃদয়ে দেয় দোলা। তার মাঝে দেবী মায়ের আগমন, ঢাকের শব্দ, ধূপধুনার মাঝে মন হয়ে ওঠে আরো উদাসীন। তাই পৌরাণিক কাহিনীকে বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে মন হয়ে ওঠে উদগ্রীব।
ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে এই পূজার সূচনা হলেও এর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় তারও প্রায় ২ মাস আগ থেকে। বিজয়া দশমীতে বিজয়া শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে এই উৎসবের সমাপ্তি হয়ে থাকে। ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও শারদীয় দূর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। পূজাকে আনন্দমূখর করে তুলতে দেশজুড়ে ইতিমধ্যেই পূজামন্ডপগুলোতে হরদমে চলছে প্রতিমা তৈরীর কাজসহ নানা সাজ-সজ্জা। ব্যস্ত সময় পার করছেন দেশের প্রতিমা কারিগররা। চৌদ্দগ্রামেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিমা তৈরীর কাজে নিজেদেরকে সপে দিয়েছেন তারা। আর্থিক বিষয়টাকে একেবারেই গৌণ হিসেব করে মনের মাধুরী দিয়ে সাজাচ্ছেন দেবী দূর্গা, দশভূজাসহ হরেক রকম প্রতিমা।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, এবার চৌদ্দগ্রামে ২৪টি পূজা মন্ডপসহ সারাদেশে প্রায় ৩২ হাজার পূজামন্ডপে দূর্গোৎসব হচ্ছে। দূর্গোৎসব চলাকালে প্রতিদিনই পূজামন্ডপে অঞ্জলী, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগআরতির আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের শারদোৎসবে দিন দিন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। নয়নাভিরাম প্রতিমা তৈরীর পাশাপাশি সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মন্ডপে মন্ডপে তোরন নির্মাণ ও আলোকসজ্জা করা হয়। পূজাকালীন সময়ে আরতি প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, নাটক, নৃত্যানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দূর্গোৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলা হয়। এসময় পূজা মন্ডপের সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ, আনসার, বিজিবিসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত থাকে। শুধুমাত্র ধর্মীয় দিক থেকে নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এ উৎসব অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। নির্দিষ্ট ধর্ম বিশ^াসকে কেন্দ্র করে সূচনা হলেও উৎসব এর রূপ নিয়ে দূর্গাপূজো হয়ে ওঠে সব সম্প্রদায়ের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সেতুবন্ধনকে সুদৃঢ় করার এক অনন্য সামাজিক উৎসব হিসেবে। চৌদ্দগ্রাম পৌরসভাধিন চাঁন্দিশকরা দাশ বাড়ি পূজা মন্ডপ, জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বরদৈন কর্মকার বাড়ী সার্বজনীন পূজা মন্ডপ, উজিরপুর ইউনিয়নের ঘাসীগ্রাম সেন বাড়ি পূজা মন্ডপ, কালিকাপুর ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর শীল বাড়ি পূজা মন্ডপ, গুনবতী ইউনিয়নের শুরীকরা উকিল বাড়ি পূজা মন্ডপ, মুন্সীরহাট ইউনিয়নের ডাকরা নাথ বাড়ি পূজা মন্ডপ, শুভপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া কালী মন্দির পূজা মন্ডপসহ উপজেলার কয়েকটি পূজা মন্ডপ ঘুরে দেখা যায়, প্রতিমা তৈরীর কাজে শেষ মুহুর্তের ব্যবস্থায় রয়েছে প্রতিমা কারিগররা। তুলির আঁচড়ে প্রতিমাকে মনোমুগ্ধকর আল্পনায় বাহারী রঙে সাজাচ্ছেন তারা।
এবিষয়ে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চৌদ্দগ্রাম উপজেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবু প্রমোদ রঞ্জণ চক্রবর্তী জানান, “শারদীয় দূর্গোৎসব হচ্ছে অসত্যকে পরাভূত করে সত্য ও ন্যায়ের বাতাবরণ প্রতিষ্ঠার শুভ সময়। দশভূজা দুর্গতিনাশিনী দেবী দূর্গা ধরণিতে আগমন করে শরতের মোহনীয় সময়কালে সত্যকে প্রতিষ্ঠার সহায়ক। সার্বজনীন দূর্গোৎসবের মূলবাণী হচ্ছে, সর্বস্তরের মানুষের সাথে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে এবং সবার উদ্যোগে সমন্বিতভাবে পূজার আয়োজন করা। যার মাধ্যমে হিন্দুদের মধ্যে বর্ণ বিভাজনের ভাবনাকে দূরীভূত করে ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। বর্তমানে দূর্গোৎসবে অনেক আধুনিকতা এসেছে, আলোর বর্ণচ্ছটায় পূজা মন্ডপকে মহিমান্বিত করা অথবা একেক মন্ডপে কোন এক বিশেষ প্রতিপাদ্য বিষয়কে তুলে ধরে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করার এক রীতি চালু হয়েছে। দূর্গোৎসব হচ্ছে সব মানুষকে সত্যের অনুসারী হওয়ার পথে অনুপ্রাণিত করা এবং পৃথিবী থেকে দূর্বৃত্তায়নকে দূর করে সত্য ও ন্যায়ের পথ প্রতিষ্ঠা করা। সব পূজারী ও সমর্থকদের সেই পথেই অগ্রসর হতে হবে, যেখানে সংরক্ষিত হবে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। এবিষয়ে আমি চৌদ্দগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা করছি”।
এবিষয়ে বরদৈন কর্মকার বাড়ী সার্বজনীন পূজা মন্ডপের সাধারণ সম্পাদক বলরাম কর্মকার জানান, প্রতিমা তৈরীর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, শুধু তুলির আঁচড় দেওয়া বাকী রয়েছে। জগজ্জননী দেবী দূর্গার আগমনে আমাদের সকল দুঃখ-কষ্ট, হিংসা-বিদ্বেষ দূর হোক। পরাজিত হোক সকল অশুভ শক্তি। সকলের দেহ-মনে ছড়িয়ে পড়–ক পবিত্রতা। সবখানে ছড়িয়ে পড়–ক শান্তি-সুখের বারতা। সত্য ও সুন্দরের আলোয় আলোকিত হোক পৃথিবী।

0/কমেন্ট করুন