মঈনুদ্দীন শামীম |
আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে বাংলার জন্ম হলেও এ ভাষার লিখিত চিহ্ন পাওয়া যায় ৬৫০ সালের দিকে রচিত কিছু পদ বা কবিতায়। তারপর ‘মুখের কথায় লেখা’ এমন রূপের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও বহু বছর। এ জন্য ১৯ শতকের কালি প্রসন্ন সিংহ, প্যারিচাঁদ মিত্র, রাজা রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় আমাদের। প্রায় সকল গবেষকের মতে, চর্যাপদ হল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম লেখা।
মঈনুদ্দীন শামীম:
আজ আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি বা লেখি, ছড়া গান, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কবিতা, কথিকা রচনা করি; তারা নিশ্চয়ই জানি এই বাংলা আর প্রথম শুরু হওয়া বাংলা এক নয়। পুরনো বাংলায় যারা কথা বলতো তারা সেভাবে লেখেনি। মুখের কথাকে লেখায় প্রকাশ করতো ছন্দের আকারে। সেটা মনের আনন্দের জন্য রচিত সাহিত্য হোক অথবা পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে ধর্মচর্চা থেকে হোক। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে বাংলার জন্ম হলেও এ ভাষার লিখিত চিহ্ন পাওয়া যায় ৬৫০ সালের দিকে রচিত কিছু পদ বা কবিতায়। তারপর ‘মুখের কথায় লেখা’ এমন রূপের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও বহু বছর। এ জন্য ১৯ শতকের কালি প্রসন্ন সিংহ, প্যারিচাঁদ মিত্র, রাজা রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় আমাদের। প্রায় সকল গবেষকের মতে চর্যাপদ হল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম লেখা। তার আগে কেউ বাংলায় কিছু লিখে থাকলেও সেটা আমাদের বাংলা ভাষা ভাষীদের হাতে এসে পৌঁছেনি। এ ‘চর্যাপদের’ খোঁজ পান পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ বইঘরে। বৌদ্ধধর্মের সাধুরা সেখানে সেগুলোকে যত্ন করে রেখেছিল।
জনাব শাস্ত্রী দাবি করেন এগুলোই বাংলার প্রথম লেখা সাহিত্যরূপ। ‘চর্যাপদ’ যারা লেখেন ধর্মচর্চার পাশাপাশি তারা কিন্তু বাংলার মাটি ও মানুষের কথাও সেখানে তুলে ধরেন। কবি কাহ্নপা যেখানে “ আলিএ কালিএ বাঁট রুন্ধেলা তা দেখি কাহ্ন বিমনা ভইলা কাহ্ন কহি গই করিব নিবাস যো মন গো অর সো উ আস।” [আলো কালো বা রাত দিন মানুষের চলার পথকে বন্ধ করে দিয়েছে, তা দেখে আমি কানু হতাশ হয়ে পড়ি। আমি কোথায় যাবো? যেখানেই যাই না কেন সবখানে একই অবস্থা।] সেখানে অন্য আরেক কবি বলেন- টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী । হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশি।। [এক পাহাড়ি বালিকা বলছে – টিলায় আমার ঘর, যেখানে কোন প্রতিবেশী নেই, কিন্তু ঘরের পাতিলে ভাত না থাকলেও সব সময় মেহমানের ভীড় লেগে থাকে] প্রথমে উল্লেখ করা চরণগুলোতে কবি কানু ইশারা ইঙ্গিতে তার সাধন তত্ত্বের কথা তুলে ধরেছেন। পরবর্তী কবি তখনকার বাংলার পাহাড়ি এক বালিকার সংসারের অভাবের চিত্র তুলে ধরেছেন। যা এখনকার বাংলায়ও দেখা যায়। তারপর ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’, ‘শূন্যপুরাণ’, নাথপদ, প্রবাদ-প্রবচন, ডাক ও খনার বচন দিয়ে পার হয়ে যায় বহু বছর।
কবি বিদ্যাপতি, কবি চণ্ডীদাস, কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীসহ অনেক কবি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রচনা করেন অনেক গান, কবিতা ও কাহিনীকাব্য। যেগুলোর কোন কোনটি বুঝতে অসুবিধা হলেও কোন কোনটি ছিল একেবারেই সহজ সরল বাংলার রূপচিত্র। কবি বড়ু চন্ডিদাস তার কাহিনী কাব্যে বলেন – কে না বাঁশী বা এ বড়ায়ি এ কালিনী নই কূলে, কেনা বাঁশী বা এ বড়ায়ি এ গোঠ গো কূলে।। আকুল শরীর মোর ব্যাকুল মন বাঁশীর শব্দে মো আউলাইলো রান্ধন এখানে আবহমান বাংলার নদী, গোচারণ ভূমি, রাখাল, রাখালের বাঁশী, ঘরের রান্না বান্না ইত্যাদির ভাষাচিত্র অনেকটা পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আব্দুল হাকিম নামে মধ্যযুগের এক কবি বাংলা ভাষার প্রতি যার ভালবাসার অভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিকে আক্রমণ করে লিখেছেন এক অসাধারণ চরণ – যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। যা বাংলা ভাষা প্রেমিক সকলের মন ছুঁয়ে যাবে অনেক দিন, অনেক বছর; যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন।
এ ছাড়া ভারতচন্দ্র রায়গুনাকর, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত, কবি আলাওল, শাহ মুহাম্মদ সগির প্রমুখ কবি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তারপর আরও বেশ কিছু দিন কেটে গেল। আঠারশ সালের শুরুতে বাংলার আকাশে লাগে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের দোলা। এ দোলা ভাষা সাহিত্যও পড়ে। উইলিয়াম কেরি ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। সেখানে ব্রিটিশ তরুণদের দিয়ে এ দেশ শাসন করানোর জন্য তাদের বাংলা শেখানো হয়। মুখের কথাকে লেখায় প্রকাশ করানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রাজা রাম মোহন রায় ও ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সমৃদ্ধ করেন। আমাদের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের আগমন এক ভিন্ন প্রেক্ষিতে। ইংরেজি স্কুলে পড়াশুনা কালে ছোট বেলা থেকেই মন মননে তিনি ইংরেজি ভাষা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট ছিলেন। শুধু নিজ ভাষা নয়, নিজ ধর্মও ছেড়ে দিয়ে তিনি পাড়ি জমান বৃটেনে।
কিন্তু ইংরেজি চর্চায় তৃপ্ত না হতে পেরে ফিরে আসেন বাংলার মাঠ ঘাট আর সবুজ প্রান্তরে। কেঁদে কেটে তিনি উচ্চারণ করলেন – হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন। — তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি, পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ পরদেশে, ভিক্ষা-বৃত্তি কুক্ষণে আচরি। পালিলাম আজ্ঞা সুখে পাইলাম কালে মাতৃভাষা রূপখনি পূর্ণ মণিজালে। [দীর্ঘ সময় ইংরেজি সাহিত্য চর্চার পর অতৃপ্ত কবির মন আবার বাংলা সাহিত্য চর্চায় ফিরে আসেন, এসেই তিনি এবার বুঝতে পারেন যে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে অনেক রত্ন মাণিক রয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি বোকার মত বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে ভিক্ষুকের মত পরের ধনের লোভে মত্ত হয়ে পরের দেশ ব্রিটেনে চলে যান।] এই কবি তাঁর ভুল বুঝতে পেরে পরে মাতৃসম মমতাময়ী বাংলা ভাষার কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসেন বাংলা সাহিত্য চর্চায়। পরিণত হন প্রথম সার্থক আধুনিক বাংলা কবিতে। রচনা করেন বিখ্যাত ‘মেঘনাদবধকাব্য’সহ বহু কাব্য ও নাটক। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য ‘মেঘনাধবধকাব্যে’ কবি উচ্চারণ করেন —– সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণি বিরবাহু চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে কহ হে দেবী অমৃত ভাষিণী কোন বীর বরে বরি সেনাপতি পদে পাঠাইলা রণে পুণরক্ষকুলনিধি রাঘবারি? এ বীর রসে সমৃদ্ধ ভাষা আধুনিক বাংলা কিন্তু তখনো তা আধুনিকতার শুরু মাত্র। এ জন্য এখনকার সাধারণ পাঠকের নিকট তা কিছুটা কঠিন।
ক্রমে ক্রমে তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের হাতে পড়ে হয়ে উঠে অনন্য সুন্দর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে যান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর পদচারণা রয়েছে। নোবেল পুরস্কার জয় করে বিজয়ের ঝাণ্ডা উড়ালেন জগদ্ব্যাপী। বাংলা সাহিত্যে এমন আরও অনেক কবি ও সাহিত্যিক তাদের মূল্যবান রচনা উপহার দেন। কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন, শামসুর রাহমান, আলমাহমুদসহ আরও অসংখ্য কবি সাহিত্যিক সাহিত্য রচনা করে এ ভাষাকে নিয়ে যান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় পর্যায়ে। শুরু হয় এ ভাষার এক গৌরবময় পথচলা। যতদিন বাঙালি তার সবুজ প্রান্তরে লাল পতাকা উড়িয়ে টিকে থাকবে ততদিন এ ভাষা বিশ্ব দরবারে তার পথচলা অব্যাহত রাখবে।
লেখক: শিক্ষক,সৌদি আরব প্রবাসী।
জন্মস্থান: কুঞ্জশ্রীপুর,চৌদ্দগ্রাম,কুমিল্লা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন